
জয়ন্ত ঘোষাল: এর চেয়ে বড় ব্রেকিং নিউজ আর কী হতে পারে!
পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তন যাকে বিজেপি বলেছিল, ‘আসল পরিবর্তন’ সেটা হল না। হল প্রত্যাবর্তন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার আবার ফিরে এলেন পশ্চিমবঙ্গের সিংহাসনে। কিন্তু এই ভোটের বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রথম যে কথাটা বলতে হবে, যে বিজেপি পরাস্ত হয়েছে ক্ষমতায় আসতে পারলো না এটা যেমন সত্য কিন্তু একথাও সত্য, যে বিজেপির ২০১৬ তে বিধানসভায় ছিল মাত্র ৩ জন বিধায়ক। সেই ৩ জন বিধায়কের জায়গায় ৭৬ হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল আগেই বিজেপি হয়ে গেছে। এবারে বিধানসভায় এতগুলো আসন নিয়ে বিজেপি আসবে, এবং বিজেপি রাজনীতি তে এই মুহুর্তে পূর্ণচ্ছেদ তো নেই বরং নতুন উদ্যমে বিজেপি মমতা বিরোধী রাজনীতিতে সক্রিয় হবে।
এখন প্রশ্ন হল বিজেপি হারলো কেন ? আসুন আমরা এক এক করে আলোচনা করি। বিজেপির পরাজিত হওয়ার পেছনে আমি দশটি কারণ তুলে ধরতে চাই।
প্রথম কারণ – এই নির্বাচনে খুব বড়ো হয়ে উঠল বাঙালি জাতিসত্ত্বার রাজনৈতিক তাস, যেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব সুচতুরভাবে ব্যবহার করলেন। তিনি মোদী-অমিত শাহ কে ‘বহিরাগত’ বলে আখ্যা দিলেন। এটাতে খুব সুক্ষভাবে বাঙালি এবং অবাঙালির প্রাদেশিকতার রাজনীতি প্রচ্ছন্ন ভাবে আছে বলে অনেকে মনে করলেন। কিন্তু তারপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস সেটাকে বারবার ক্ল্যারিফাই করলেন, এবং জানালেন, যে এটা আসলে বাঙালি-অবাঙালি নয়, আসলে বঙ্গসংস্কৃতির নিজস্বতাকে আক্রমণকারী মোদী-অমিত শাহরা অনেকটা নাদির শাহের মতো আক্রমণ করতে আসছে এবং বঙ্গসংস্কৃতিকে তছনচ করে দিতে চাইছে। সুতরাং শুধু রবীন্দ্রনাথের নাম বললে তো হবে না, বঙ্গসংস্কৃতিটাকে জানতে হবে। এমনকি বিজেপির সভাপতি জে.পি.নাড্ডা যখন বললেন, জোড়াসাঁকোতে নয় শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ জন্মেছেন। এতো তুচ্ছ একটা ভুল সেটাও কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। যারা রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থানই জানে না তারা কী বঙ্গসংস্কৃতি শেখাতে আসছে ? সুতরাং এখানে বাঙালি গর্ব, যে রেনেসাঁ শহর কলকাতা, উনবিংশ শতাব্দীর সবথেকে বড় সাংস্কৃতিক শহর। ১৯১১ সালে রাজধানী স্থানান্তর করে ব্রিটিশরা নিয়ে গিয়েছিল। বাণিজ্যিক রাজধানী হয়ে গেল বোম্বে। দিল্লি রাজনীতির মক্কা হয়েগেল। আর পশ্চিমবঙ্গ লবডঙ্কা। ঠিক একটা সময়ে সিপিএম যেরকম ভাবে বঞ্চনার রাজনীতি করতো, যে পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি সিপিএম ‘মাসুল সমীকরণ নীতি’ থেকে শুরু করে রাজস্ব পর্যন্ত সব ব্যাপারে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগের তর্জনী তুলতো আর বলতো ‘বিমাতাসুলভ মনোভাব’। সেই একই রাজনীতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করলেন এবং দেখিয়ে দিলেন, যে কীভাবে এই ‘বেঙ্গলি আইডেন্টিটি’ টাকে ব্যবহার করা যায়। বেঙ্গলি আইডেন্টিটি ব্যবহার করা মানেই হিন্দু ভোটকে বিজেপি ‘জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে সুসংহত করতে চেয়েছিল। সেটা সম্ভব হল না কেননা, বাঙালি তো
হিন্দু এবং মুসলমান দুপক্ষই আছে। মুসলমান সমাজ যেরকম আরও বেশি করে মমতার দিকে কনসলিডেটেড হয়েছেন সেটা পরে আলোচনায় আসছি। কিন্তু বাঙালি, সে বাঙালি হলেও তার যে হিন্দু সমাজ তারা কিন্তু বিজেপি কে ভোট না দিয়ে বাঙালিত্বের কারণে তারা মমতার পক্ষে ভোট দিল। ২০১৯ এ বিজেপি ১৮ টা আসন পেয়েছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যে অমিত শাহ যখন রোডশো করেছিল, তখন কলেজস্ট্রিটে বিদ্যাসাগর কলেজে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছিল। সেটার জন্য বিজেপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কলকাতার মূল শহরের প্রায় ৯ টা আসন বিজেপি কিন্তু পাইনি, তৃণমূল পেয়েছিল। সেই সময় থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝতে পেরেছেন, যে বাঙালির জাতিসত্ত্বার রাজনীতি টা এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।
দ্বিতীয় কারণ – মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমবেত ভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে, তার ফলে তিনি একটা
ভিকটিম স্ট্যাটাস পেয়েছেন। এতবড় একটা শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘনঘন কলকাতায় আসছেন। এত ঘনঘন জনসভা করছেন। দেশের একটা বিধানসভা নির্বাচনের জন্য কোনো প্রধানমন্ত্রী এতবার আগে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কখনো আসেননি। এই যে প্রধানমন্ত্রীর আসা, অমিত শাহের আসা, নাড্ডার আসা, ডজন ডজন বিজেপির নেতা-সাংসদের আসা, যেটাকে বলে ‘ওভার ডু’। এটাও অনেকসময় কেন্দ্রের অতিহস্তক্ষেপ বাঙালির বোধহয় পছন্দ হয়নি। রান্নার অনেক উপাদান ছিল। অনেক রকমের শাক-সবজি, সুন্দরভাবে কাটাকুটি করা হয়েছিল, মশলাটশলা সবই ছিল। কিন্তু নুন অনেক বেশি পড়েগেল। ওই অতিসক্রিয়তা কেন্দ্রের। এই যে এনফরসমেন্ট, সিবিআই অভিষেকের বাড়িতে যাচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব সুনিপুণ ভাবে, তাঁর কমিউনিকেশন স্কিলকেও মারত্মক রকমের বলতে হবে। তিনি তাঁর মতো করে মেঠো স্টাইলে, তাঁকে যতই নিন্দে করা হয়েছে। তাঁকে বলা হয়েছে, এটা তাঁর বিরুদ্ধে যাচ্ছে, তিনি ভিকটিম স্ট্যাটাস হয়েছেন। একটা সময়ে কংগ্রেস যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীকে নানান রকমভাবে আক্রমণ করত, এবং শয়তান পর্যন্ত বলেছিল, সেগুলো কিন্তু সবই মোদীর পক্ষে গেছিল। সুতরাং এই একইরকম ভিকটিম স্ট্যাটাসের কার্ডটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খেলতে সক্ষম হয়েছেন।
আরও পড়ুন: পশ্চিমবঙ্গ ভোটকে জাতীয় বিধানসভা ভোট কেন বলা হচ্ছে ?
তৃতীয় কারণ- মেরুকরণ যেটা বিজেপি ভেবেছিল হবে, সেটা শতকরা ৩০ ভাগ মুসলমান সমাজ আছে অসমে এই ফলটা হয়েছিল। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব বুঝতে পারলেন না, যে অসম আর পশ্চিমবঙ্গ দুটো আলাদা রাজ্য,
আলাদা মানসিকতা। বাঙালি মানসিকতা আলাদা। কলকাতার বাঙালি এবং অসমের অহমিয়া মানসিকতার অনেক তফাৎ আছে। অনেক স্তর আছে। এগুলো কিন্তু একইরকম নয়। একটা অখণ্ড ভারত যদিও আমরা বলি। কিন্তু ভারতের মধ্যে অনেক ভারত আছে। এক একটা রাজ্যের প্রকৃতি এক এক রকমের, তার মানসিকতা এক একরকমের। সেগুলোকে না বুঝতে পেরে গড়পড়তা উত্তরপ্রদেশ বা বিহারের স্টাইলে হিন্দু-মুসলমান রাজনীতির মেরুকরণ করাটা এখানে সম্ভব হল না। কেননা বাঙালি হিন্দুরা কিন্তু ঠিক উত্তরপ্রদেশের বা বিহারের মতো
অতো রিচুয়ালিস্টিক হিন্দু নয়। এখানে আমরা বাঙালি হিন্দুরা মুসলমান রাঁধুনির হাতে খাবার খাই। বরং খানসামা এবং বিভিন্ন মুসলমানদের মনে হয় যে তাদের হাতের রান্না অনেক সুস্বাদু। এমনকি মুসলিম দোকানে ঘনঘন বিরিয়ানী খাওয়ার জন্য বাঙালি হিন্দুদের প্রায়শই উইকেন্ডে যেতে দেখা যায়। এই বাঙালি হিন্দু কিন্তু অনেক কসমোপলিটন হিন্দু। অনেক প্লুরালিস্টিক বহুত্ত্ববাদী হিন্দু। এই বাঙালি সমাজে যেটা অর্মত্য সেন বারবার বলেন, যে বৌদ্ধদের প্রভাব ছয়শো বছরের, মুসলমান দের প্রভাব চারশো বছরের, ব্রিটিশ দের শাসন দুশো বছরের। এইসব প্রভাব মিলে বাঙালি নামক যে মন্ডটি তৈরি হয়েছে, সেটাকিন্তু একটা বহুত্ত্ববাদী একটা মন্ড। সেটাকে কিন্তু স্টিমরোলার চালিয়ে হিন্দু-মুসলমান করা যায় না। এর পাশাপাশি মুসলমান সমাজ কিন্তু আরও অনেক বেশি কনসলিটেড হয়ে মমতার দিকে চলে গেছে। বিজেপি যত আক্রমণকারী হয়েছে, ততই মুসলমান সমাজ ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছে। যেখানে ওয়েসি এবং সিদ্দিকীর ইন্ডিয়ান স্যেকুলার ফ্রন্ট কার্যকর হতে পারেনি। কারণ মমতা কিন্তু সুনিপুণ ভাবে প্রচার করেছে ওরা বিজেপির টিম, ওদেরকে ভোট দেয়া মানে বিজেপির বাক্সে ভোটটা পড়বে। ভারতের স্বাধীনতার আগে একসময় মুসলিম লীগ পশ্চিমবঙ্গ তখনও হয়নি মানে বঙ্গদেশে সবথেকে বেশি ভোট পেয়েছিল। কিন্তু তারপরে কখনো মুসলমানদের জন্য পার্টি হয়নি। এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে হল। তারা কিন্তু কিছু করতে পারলো না। বাঙালি মুসলমান, উর্দুভাষী মুসলমান রা বুঝতে পেরেছিল, যে এরকম আলাদাভাবে যদি মুসলমান ভোট দেয়া হয়, এবং মুসলমান ভোট যদি ভেঙে যায় তাতে লাভ হবে বিজেপির। সুতরাং সেটাও কিন্তু হল না। তার ফলে মেরুকরণের তত্ত্ব হিন্দু সমাজে সসুংহত হয়ে বিজেপির পাশে এসে দাঁড়ালো না।
চতুর্থ কারণ- আমি বলবো প্রশান্ত কিশোরের ম্যানেজমেন্টকে নিশ্চই কৃতিত্ব দেয়া উচিত। তার কারণ গর্ভমেন্সর ব্যাপারে যে মিসরুল ছিল, পশ্চিমবঙ্গে মমতার বিরুদ্ধে যে একটা মানসিকতা তৈরি হয়েছিল, জেলায় জেলায় তোলাবাজি, সিন্ডিকেটরাজ এর মতো অভিযোগ উঠেছিল, একটা পারসেপশন তৈরি হয়েছিল এবং বিজেপি প্রচার করছিল। তার বদলে অনেকদিন আগে থাকতেই, বছরখানেক ধরে মমতার সঙ্গে কথা বলুন, বাংলার কন্যা, তারপরে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড, ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য সমস্ত ব্যবস্থা, বিনাপয়সায়, অল্প পয়সায় খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা। নানান রকমের পপুলিস্ট মেজরস যাকে বলা হয়, সেগুলো মমতা নিয়েছিল। সেখানে পি.কে এর একটা বুদ্ধি কাজ করেছিল। সেটা একটা মস্তবড় ভূমিকা নিয়ে ছিল।
পঞ্চম কারণ- তৃণমূলকে ভাঙিয়ে আনার যে রণকৌশল সেটাও মমতার পক্ষেই গেছে। তার কারণ তারা কিন্তু কেউ জিততে পারেনি, যারা রাতের অন্ধকারে বিশেষ বিমানে অমিত শাহের বাড়িতে এসে পৌঁছেছিল। বাঙালি বোধহয় সেটা ভালো চোখে দেখেনি। বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই তাদের মনে করা হয়েছিল। তৃণমূল ভেঙেও বিজেপি খুব একটা লাভ পেলো না। বিজেপি যতবেশি করে বলেছে, আমরা দুশো পার করবো, মাইন্ডগেম খেলতে গেছিলো। সেগুলো সবই তাদের বিরুদ্ধে গেছে।
ষষ্ঠ কারণ- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাইক্রো-ম্যানেজমেন্ট টাও অসাড়ে করেছেন। কোথায় রাজবংশীদের একজন স্বঘোষিত মহারাজা অনন্ত মহারাজ, একটা সময় তার বিরুদ্ধে তৃণমূল মামলাপত্র রুজু করেছিল। সে পালিয়ে চলে গেছিলো অসমের জঙ্গলে। অমিত শাহ তার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলো। রাজবংশীদের ওপরে
তার প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমিসারি পাঠিয়ে তাকে টেনে নিয়ে চলে এলো তৃণমূল কংগ্রেসে। যেরকম গুরুং এর ব্যাপারটা। তার ব্যাপারটা ন্যায় নীতির কথা যাই বলা হোক, যদি অমিত শাহের কথা বলি সাম, দাম, দন্ড, ভেদ- এর চাণক্য নীতি। তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেই বা কেন বলা হবে না ? সুতরাং ঝাড়গ্ৰামে কোথায় মাওবাদীদের প্রভাব আছে, কোথায় নকশালদের প্রভাব আছে। যাকে যেভাবে ব্যবহার করা, সেটাই তিনি করেছেন, এবং সেখানে তিনি সফল হয়েছেন। এমনকি যারা অতিবামপন্থীরা, যারা ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ঘোষণা করেছিল। তাদের সম্পর্কে প্রশংসা করা। দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের মতো নকশাল নেতার প্রশংসা করা। এগুলো সবই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে করেছেন।
আরও পড়ুন: বিজেপির কলকাতা জয়ের সম্ভাবনা কতটা? ইতিহাস তুলে বিশ্লেষণে জয়ন্ত ঘোষাল
সপ্তম কারণ- অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভাইপো ভাইপো ভাইপো বলে ‘ভাইপো’ শব্দটাই অবাঙালিরা জেনে ফেললেন। ভাতিজা মানে হল ভাইপো। সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে যখন সিআইবি বা এনফরসমেন্ট পাঠানো হল, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিলেন। তিনি রক্ষণাত্মক ব্যাটে খেললেন না। তিনি অভিষেকের বাড়িতে চলে গেলেন। তার বাচ্চা কন্যাকে কোলে তুলে নিলেন। বিভিন্ন ইন্টারভিউতে বললেন, অভিষেককে ভয় পেতে বারণ করলেন। উল্টে অভিষেককে স্টার ক্যাম্পেনার করে দিলেন। বিজেপি তাকে নেতা বানিয়ে ফেলল। এই আক্রমণাত্মক রণকৌশল মমতার পক্ষে গেছে। সেখানে তিনি কোনো রেয়াত করেননি। বিজেপি যা যা করেছে প্রত্যেকটার মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছেন। যেরকম বিজেপি মমতার মতুয়া ভোট থেকে শুরু করে সব ব্যাপারে হাত দিতে গেছে। তেমনি মমতাও কিন্তু বিজেপির সেই সমস্ত খেলা গুলোতে উল্টো খেলা খেলেছেন।
অষ্টম কারণ- ‘খেলা হবে’ গান যিনি তৈরি করলেন,আমি জানি না তিনি এখন তৃণমূলে আছেন কিনা ? কিন্তু তার গানটা শুনে মমতার যেটা মনে হয়েছিল খুব জনপ্রিয় হয়েছে। সেটা জনসমাজে তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে মমতা ও পি.কে রা গানটাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের হাতিয়ার করলেন। সেই ‘খেলা হবে’ গানটা বিভিন্ন প্রচারের জনসভায় গাওয়া হতে লাগলো। এটা একটা কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক। সেটাকে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়, বিভিন্ন ইভেন্টে সোপঅপেরায় ‘খেলা হবে’ ‘খেলা হবে’ – এটাকে এতো জনপ্রিয় করে তোলা হল। আর বিজেপি যত এটার বিরোধিতা করতে লাগলো। নরেন্দ্র মোদী এসে বলল, ‘খেলা নয় খেলা হবে না বিকাশ হবে’। তাতে কিন্তু পরিস্থিতির কোনো তফাৎ হলো না। ‘খেলা হবে’ কোনো নেতিবাচক শব্দ নয়। রবীন্দ্রনাথও ‘খেলা ভাঙার খেলা’ থেকে শুরু করে নানান শব্দ বলেছেন। বাঙালির বোধহয় অবচেতন মনে খেলা শব্দটার প্রতি প্রেম আছে। নতুন প্রজন্মের ও ভালো লাগলো। কেননা ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, ক্রিকেট সব খেলার সাথেই বাঙালির একটা কোথাও একটা সংযোগ আছে। সেই জন্য মমতা ‘খেলা হবে’ শব্দটাকে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন।
নবম কারণ- জাতির ভোট অর্থাৎ সিডিউল কাস্ট ভোট, ওবিসি ভোট, এই জাতির ভিত্তিতে ভোট সিপিএম কখনোই করতো না। শ্রেণীর ভিত্তিতে করতো। মতুয়া ভোট মমতার নিজের হাতে লালিত পালিত। মতুয়া মাকে সবথেকে বেশি যত্ন করে হাসপাতালে নিয়ে আসা সবকিছু মমতা করেছিলেন। বিজেপি সেখানে খাবলা বসাতে চেয়েছিল। শান্তনু ঠাকুর বিজেপির লোকসভায় জিতে ছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জাতপাতের ভোট ব্যাঙ্ককে সুসংহত রাখতে সক্ষম হলেন।
দশম কারণ – মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা মুখ। শুধু তিনি আর অন্য কোনো ছবিকে নয়। এমনকি অভিষেক কেও একটা লক্ষ্মণ রেখার মধ্যে রাখা হয়েছিল। তিনি হয়তো দ্বিতীয় স্টার ক্যাম্পেনার হয়েছিলেন। সব জায়গায় যেতেন। লোকজনও হতেন। কিন্তু মমতাই হচ্ছেন প্রধান কাম্পেনার। আহত অবস্থায় হুইলচেয়ারেও কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা সেন্টিমেন্ট দিয়েছেন। সবটা মমতা কেন্দ্রিক করে তোলা। তার বিরুদ্ধে সমবেত
ভাবে লড়াই হচ্ছে একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী, যাকে এইভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে। তার ফলে মহিলা ভোট ব্যাঙ্ককে মমতা আরও সুসংহত করতে পেরেছিলেন। মমতা নিজের মতো করে মহিলা ভোটব্যাঙ্ক টাকে গড়ে তুলেছিলেন। আমার মনে আছে, তিনি যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন পরিচারিকা যারা দূর থেকে শিয়ালদহ রেল স্টেশন বা অন্যান্য জায়গায় আসতো, তাদেরকে ফ্রি মান্থলি পাসের ব্যবস্থা করা। এই সমস্ত মমতা করেছিলেন। তাই জন্য সেই ভোটব্যাঙ্ক টা কিন্তু এখনো মফস্বলে খুব শক্তিশালী আছে। সেটাও কিন্তু মমতার পক্ষে কাজ করেছে। সবমিলিয়ে বিজেপির প্লট বাঞ্চাল করে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার ফিরে এলেন। এখানে
একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিরোধী দল হিসেবে একটা দক্ষিণপন্থী শক্তি বিরোধী দলের ভূমিকায় এসে গেল। সুতরাং আগামীদিনে মমতাকে অনেক সচেতন ভাবে এগোতে হবে। সেখানে লড়াইটা আরো জমবে। এই যে পরিস্থিতিটা উদ্ভূত হল, সেখানে মমতা এখন কলেবরে নতুন সরকার গঠন করবেন, নতুন মুখ নিয়ে আসবেন। কিন্তু খেলা শেষ হলো না। এখনো নব নব রূপে খেলা হবে।
আরও পড়ুন: তৃণমূল না বিজেপি, পাল্লা ভারী কোন দিকে? বিশ্লেষণে জয়ন্ত ঘোষাল
সবশেষে বলা যায়, কংগ্রেস এবং সিপিএমের ভোটব্যাঙ্ক সেটা যে ফেরত পাওয়ার একটা আশা ছিল, সেটাও যে হল না। সেটা বিজেপির দিকে গেলো, সেটা যেমন মমতার জন্য খারাপ হয়েছে। কিন্তু সিপিএমের যে মুসলমান ভোটটা ছিল, সেটাও কিন্তু সিদ্দিকীর সঙ্গে জোট বাধায় উল্টে হিতে বিপরীত হল। সিপিএম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। মুসলিম ভোট যদি সিপিএম কিছুটা কাটতো, নবীন প্রজন্মের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা যারা দাঁড়িয়েছে, তারা যদি ভোট কাটতো, তাহলেও মমতার বিপদ হতো। সুতরাং না কংগ্রেস না সিপিএম কারুর সাথেই বোঝাপড়ায় মমতা যাননি। সুযোগ ছিল, ভয় পেয়ে গিয়ে যদি কোয়ালিশনের কথা ভেবে কংগ্রেস বা সিপিএমের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে পারতেন, তিনি কিন্তু সেটা করেননি। ঝুঁকি নিয়েছেন। যার জন্য কংগ্রেসের অসুবিধা হয়েছিল, এবং অধীর চৌধুরী, আব্দুল মান্নানরা ভুল প্রমাণিত হলেন। সেখানে সোনিয়া গান্ধী-রাহুল গান্ধী উভয় সঙ্কটে এখন পড়ে গেলেন। আগামীদিনে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচন আরও ইন্টারেস্টিং হয়ে গেল, কেননা তৃণমূল যদি
হেরে যেতো বিজেপি যদি জিততো। তাহলে ২০২৪ এর নরেন্দ্র মোদীর পথনির্দেশিকা আরও স্পষ্ট হতো। মমতা তথা বিরোধীদের ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে করোনার এই মিস-ম্যানেজমেন্টের মধ্যে নরেন্দ্র মোদী আরও হইহই করে পশ্চিমবঙ্গের বিজয়টাকে মূলধন করে এগিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু সেটা যখন হলো না।
তার উল্টোটা কী হবে ? উল্টোটা হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধীদের ঐক্যের একটা ফালক্রাম্পে পরিণত হবেন। তাঁকে এখন শরদ পাওয়ার ফোন করছেন, স্ট্যালিন ফোন করছেন। বিরোধী সমস্ত নেতারা, কেজরিওয়াল ফোন করছেন। মমতার নেতৃত্বে আগামীদিনে বিরোধী ঐক্যের প্রতিষ্ঠা হবে। ইউপিএ আবার পুনরুজ্জীবিত হবে। সেখানে সোনিয়া গান্ধী চেয়ারপারসন আছেন। এখন সেই চেয়ারপারসনের পদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসবেন, না শরদ পাওয়ার আসবেন কে কনভেনার হবেন, এগুলো এক্ষুনি হবে না। কেননা এখন করোনা মোকাবেলা হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম কাজ। দ্বিতীয় কাজ হল নতুন সরকার গড়ে এখন খোলনলচে বদলানো। নন্দীগ্ৰামের বিপর্যয়ের কারণ খুঁজে বের করা। করোনার এই পর্ব অতিবাহিত হলে সবশেষে আমার মনে হয়, আপাতত যোগাযোগ থাকলেও ছমাস পর বিরোধী নেতৃত্বের কাজকর্ম শুরু হবে। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন এসে যাবে। উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে অখিলেশ কী করে সেটা দেখার। তারপর উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে বিজেপির যদি বিপর্যয় হয়, তাহলে বিরোধীরা আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ নেবে। তবে বিজেপি উত্তরপ্রদেশে কী রণকৌশল নেবে সেটাও এখন দেখার বিষয়।
সুতরাং এখন জাতীয় রাজনীতিতে সলতে পাকানোর সময়, এখনই চূড়ান্ত কিছু হচ্ছে না। তবে এখন আরম্ভের আগের আরম্ভ শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং খেলা শেষ নয় খেলা শুরু।
The post ফের নবান্ন দখল ঘাসফুলের, মমতার প্রত্যাবর্তনের কারণ খুঁটিয়ে দেখলেন জয়ন্ত ঘোষাল appeared first on Kolkata24x7 | Read Latest Bengali News, Breaking News in Bangla from West Bengal's Leading online Newspaper.
from Kolkata24x7 | Read Latest Bengali News, Breaking News in Bangla from West Bengal's Leading online Newspaper https://ift.tt/3xJe7Pq
No comments:
Post a Comment