
সুমন ভট্টাচার্য: ছোটবেলায় একটা মারপিটের স্মৃতি আজও, এই পঞ্চাশের প্রান্তে পৌছেও আমার খুব টাটকা|
আমার এক দূর সম্পর্কের বোনকে পাড়ার কিছু ছেলে প্রেমনিবেদন করতে এসেছিল| তাই নিয়ে কথা কাটাকাটি, সেই থেকে হাতাহাতি| কারা প্রথম হাত চালিয়েছিল সেটা আজ আর মনে নেই, কিন্তু বিপক্ষ শিবিরের সবাইও যে খেলার মাঠে আমাদের বন্ধু ছিল, এটা স্পষ্ট মনে আছে|
আসলে যে ছেলেটি আমার দূর সম্পর্কের বোনকে প্রেম নিবেদনের চেষ্টা করছিল, তাঁর দিদির প্রতি যে আমার একটা দূর্বলতা ছিল, সেটা আমাদের উত্তর শহরতলির সবাই জানত| সেই কারণেই কিনা জানি না, আমার কৈশোরের প্রথম গোষ্ঠী সংঘর্ষে আমি আর আমার বান্ধবীর ভাই সবচেয়ে বেশি আহত হলাম| ওর ভাঙল হাত আর আমার নাক….
তারপর অনেকদিন খেলার মাঠে দেখা হলেও আমরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলতাম না| কেমন যেন রাগ রাগ চোখে চোখে একে অপরের দিকে তাকাতাম| তারপর একদিন ওর দিদি, আমার ছোটবেলার প্রথম বান্ধবী হাসপাতালে অপারেশন করাতে গিয়ে মারা গেল| আমরা, মানে বিপক্ষ শিবিরের সবাই হাসপাতালে ছুটে গেলাম| আমার বন্ধু থেকে শত্রু হয়ে যাওয়া ছেলেটি, ক্রিকেট মাঠে আমার প্রিয় ফাস্ট বোলার কিশোর আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল|
ওহ, বলতে ভুলে গেছি, হাসপাতাল থেকে আমার কৈশোরের প্রথম বান্ধবীর মৃতদেহ যখন গাড়িতে করে বার করা হচ্ছে, তখন দেখলাম বাইরে আমার সেই দূর সম্পর্কের বোন এসে দাঁড়িয়ে আছে|
কেন জানি না, এরপর থেকে আমি পাড়ায় কম থাকতাম| কিন্তু শুনতে পেতাম আমার সেই দূর সম্পর্কের বোন আর মৃতা বান্ধবীর ভাইকে প্রায়ই একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে| তার কিছুদিন বাদে, আমাদের সেই উত্তর শহরতলির পাড়া, ক্রিকেট খেলা, রকের আড্ডা, সরস্বতী পুজোকে চিরতরে বিদায় জানানোর আগে সিঁথির মোড়ে আমার সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া বান্ধবীর ভাই আর দূর সম্পর্কের বোনের দেখা হল| অনেক গল্প, হাসাহাসির পরে আমি ওদের আইসক্রিম খাইয়েছিলাম| সন্ধ্যাশেষে রাত নামার আগে আমি যখন শহরের দিকে আসার জন্য বাস ধরছিলাম,তখন ওরা হাত ধরাধরি করে রিক্সায় উঠছিল….
এখনও কোনও পারিবারিক অনুষ্ঠানে কচ্চিত কদাচিত আমার সেই দূর সম্পর্কের বোনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে,ওর বর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে, দিদি কিন্তু তোমাকে খুব ভালবাসত গো….
আমি একটিবার চুপচাপ নিজের নাকে হাত বুলিয়ে নিই…
পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক হিংসার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আমার জীবনের প্রথম গোষ্ঠী সংঘর্ষের কথা এত সাতকাহন করে লেখার কারণ, আমি সবসময় বিশ্বাস করি যে কোনো সংঘর্ষের পিছনে আরো অনেক ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিবাদ, বিসংবাদ জড়িয়ে থাকে| সেই রাগ, অসূয়া, না পাওয়ার যন্ত্রণা পুঞ্জিভূত হয়ে একটা হিংসার জন্ম দেয়| যা ঠেলে দেয় সংঘর্ষের দিকে|
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংঘর্ষের ইতিহাসের সঙ্গেও এইরকম অনেক টুকরো টুকরো কারণ জড়িয়ে আছে| কোথাও জমির বিবাদ তো কোথাও পারিবারিক কর্তৃত্বের জন্য চাপানউতোর| এবং এই টানাপোড়েনটা অনেক এলাকাতেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে| তাই সরকার বদলায়, ঝান্ডার রং বদলায়, কিন্তু এই রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসা থামে না|
সিপিএমের দীর্ঘ ৩৪ বছর এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ১০ বছরের শাসনকালের রাজনৈতিক সংঘর্ষের কারণ অনুসন্ধান করলেই বোঝা যাবে সেখানে আদর্শগত লড়াইয়ের চাইতে স্বার্থের সংঘাত অনেক বেশি| সেই স্বার্থের মধ্যে ঠিকাদারির বরাত থেকে গ্রামে কর্তৃত্বস্থাপনের লড়াই, সবই রয়েছে| এবং এইসব তথাকথিত ছোট স্বার্থের সংঘাতই রক্তপাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়| তাই বাকি সবকিছু বদলে গেলেও রাজনৈতিক সংঘর্ষ বন্ধ হয় না|
The post প্রেম অথবা মারপিটের গল্প, আর সংঘর্ষের রাজনীতি এবং অরাজনীতি… appeared first on Kolkata24x7 | Read Latest Bengali News, Breaking News in Bangla from West Bengal's Leading online Newspaper.
from Kolkata24x7 | Read Latest Bengali News, Breaking News in Bangla from West Bengal's Leading online Newspaper https://ift.tt/3eTqGPv
No comments:
Post a Comment